বাপেক্স বর্তমানে অনশোর (ভূ-ভাগ) অনুসন্ধানে অগ্রগামী হলেও অফশোর (সমুদ্র) অনুসন্ধানে তাদের ন্যূনতম প্রযুক্তি ও অবকাঠামো নেই। তাদের এসব বাড়াতে হবে, দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ঘাটতি ১৩০ কোটি ঘনফুট
২০২৬ সাল শেষে এসব থেকে সুফলের প্রত্যাশা
দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের যে পরিমাণ চাহিদা তার বিপরীতে ঘাটতি ১৩০ কোটি ঘনফুট। আর চাহিদা যে হারে বাড়ছে সে হারে উৎপাদন বাড়ছে না। তবে গ্যাসের বাড়তে থাকা চাহিদা পূরণ ও সঙ্কট নিরসনের জন্য দেশে ১৫টি কূপ অনুসন্ধান ও খননের কাজ চলছে। সিলেট গ্যাসফিল্ডের আওতায় চলমান এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৬৯৮ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এসব প্রকল্প আগামী ২০২৬ সালে সমাপ্ত হওয়ার কথা। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে আসছে ৭০ কোটি ঘনফুট। ফলে দৈনিক ১৩০ কোটি ঘনফুট ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ দিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাপেক্স বর্তমানে অনশোর (ভূ-ভাগ) অনুসন্ধানে অগ্রগামী হলেও অফশোর (সমুদ্র) অনুসন্ধানে তাদের ন্যূনতম প্রযুক্তি ও অবকাঠামো নেই। তাদের এসব বাড়াতে হবে, দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সিলেট গ্যাসফিল্ডের তথ্য বলছে, শুধু সিলেট গ্যাসফিল্ডের আওতায় চলমান রয়েছে ১৫টি কূপ অনুসন্ধান ও খনন প্রকল্প। এর মধ্যে ৫১৭ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২১ সালে নেয়া সিলেট ১০ নং কূপ (অনুসন্ধান কূপ) খনন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের অগ্রগতি এ পর্যন্ত ৭০.৭২ শতাংশ। ১৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে চলমান হরিপুর গ্যাসফিল্ডে দৈনিক ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেস প্লান্ট স্থাপন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০২২ সালে নেয়া হয়। যার অগ্রগতি ৯৯.৭৮ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে নেয়া ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ের কৈলাশটিলা-২, রশিদপুর-২, রশিদপুর-৫ ও সিলেট-৭ নং কূপ ওয়ার্কওভার (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পটির অগ্রগতি ৯৯.৯৯ শতাংশ বা শেষ বলা চলে।
অন্য দিকে ২০২৪ সালে অনুমোদিত ৫৯৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের সিলেট-১১ (উন্নয়ন কূপ) ও রশিদপুর- ১৩ (অনুসন্ধান) কূপ খনন প্রকল্পটির অগ্রগতি ১৪.২৯ শতাংশ। চলতি বছরে ২২৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদিত কৈলাশটিলা-১, রশিদপুর-৩ ও বিয়ানীবাজার-২ নং কূপ ওয়ার্কওভার প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৬.৬৬ শতাংশ। রশিদপুর-১১ (অনুসন্ধান কূপ) খনন প্রকল্প ২০২৪ সালে নেয়া হয় ২৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে। আর এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ০.০৯ শতাংশ। ২০২৪ সালে অনুমোদিত ডুপিটিলা-১ ও কৈলাশটিলা-৯ (অনুসন্ধান কূপ) প্রকল্পটির বাস্তবায়ন খরচ ৬৪৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে মোট ৪.৪৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর কাজের অগ্রগতি পরে নেয়া প্রকল্পগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অগ্রগতি পর্যালোচনার তথ্য বলছে, সিলেট ১০ নম্বর কূপ প্রকল্পের খনন সম্পন্ন করে ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর প্রথম ডিএসটি চলাকালীন দৈনিক ২.২ থেকে ২.৫ কোটি ঘনফুট হারে ফ্লোর বিপরীতে ওয়েলহেড প্রেসার ৩ হাজার ২৫০ পিএসআইজি পাওয়া গেছে। ওই কূপ হতে দৈনিক ২ কোটি ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সিলেট গ্যাসফিল্ডের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গ্যাস প্রাপ্তি সাপেক্ষে গ্যাস গ্যাদারিং পাইপলাইন নির্মাণ চলমান রয়েছে। নতুন একটি গ্যাস কূপ সিলেট-১০ এক্সের জন্য সিসিডিসি চায়নার দাখিল করা ড্রয়িং ও ডিজাইন অনুযায়ী রিগ ফাউন্ডেশন সম্প্রসারণের জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিসিডিসি চায়না কর্তৃক খনন রিগ ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, তৃতীয় পক্ষীয় প্রকৌশল কাজের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক, খনন মালামাল এবং প্রয়োজনীয় জনবল খনন সাইটে মবিলাইজেশনের জন্য চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঠিকাদারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ স্থানীয় ঠিকাদার মেসার্স বেলাল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে সিলেট-১০ এক্স নং কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ ফাউন্ডেশন সম্প্রসারণের কাজ চলমান। আর হরিপুর গ্যাসফিল্ডের প্রসেস প্লান্ট স্থাপন কাজ এবং প্রি-কমিশনিং শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে প্লান্টের কমিশনিং শুরু হয়েছে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী টেস্ট রান সফলভাবে সম্পন্ন করে বর্তমানে ওই প্লান্টের মাধ্যমে দৈনিক কমবেশি সাড়ে ১১ এমএমএসসিএফডি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্য দিকে কৈলাশটিলা-২নং কূপ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে দৈনিক ৬২ লাখ ঘনফুট, রশিদপুর-২ নং কূপ থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দৈনিক ৮৩ লাখ ঘনফুট ও সিলেট ৭নং কূপ হতে ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর থেকে দৈনিক ৮২ লাখ ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রিডে যুক্ত করা হয়। বর্তমানে উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। কূপগুলো থেকে দৈনিক প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট হারে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে নিরবচ্ছিন্নভাবে সঞ্চালিত হচ্ছে।
এ দিকে সিলেট-১১ ও রশিদপুর-১৩ কূপ খনন ঠিকাদার চায়নার সিনোপেক ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম সার্ভিস করপোরেশনের সাথে টার্ন-কি ভিত্তিতে দুটো কূপ খনন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রশিদপুর-১৩ কূপের জন্য ৯.৭৭৮ একর ভুমি অধিগ্রহণ ও সিলেট-১১ নং কূপের জন্য ৩.৯৩১ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পের বৈদেশিক পরামর্শক সেবা সংগ্রহে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বান করা হয়। প্রাপ্ত ৯টি আবেদনপত্র থেকে মূল্যায়নে উত্তীর্ণ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নিকট গত ১৮ মার্চ রিকোয়েস্ট অব প্রপ্রোজাল পাঠানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন প্রক্রিয়াধীন আছে।
অগ্রগতির তথ্য বলছে, রশিদপুর ৩নং কূপের রিগ ফাউন্ডেশন মডিফিকেশনের জন্য নির্বাচিত ঠিকাদারের সাথে চলতি বছর মার্চে চুক্তি করা হয়েছে। ঠিকাদার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। কৈলাশটিলা-১নং এবং বিয়ানীবাজার-২নং কূপের রিগ ফাউন্ডেশন মডিফিকেশনের জন্য নির্বাচিত ঠিকাদারের সাথে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ঠিকাদার কাজও শুরু করেছে। এ ছাড়া রশিদপুর-১১ নং কূপ (অনুসন্ধান কূপ) খননের মালামাল, প্রকৌশল সেবা, মোবিলাইজেশন ও ডিমোবিলাইজেশন ইত্যাদিসহ খনন অপারেশনের কাজের জন্য টার্ন-কি ভিত্তিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়নার সিসিডিসির সাথে ৪ কোটি ৩২ লাখ ৪১ হাজার ৪৩০ মার্কিন ডলার এবং স্থানীয় মুদ্রায় ১১৭ কোটি ৯ লাখ ৮ হাজার ২৮০ টাকায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চুক্তি হয়েছে। ওই কূপের ভূমি অধিযাচন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
পেট্রোবাংলার ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের তথ্য ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে। যার মধ্যে ২০টি থেকে নিয়মিত গ্যাস উত্তোলন চলছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স), পেট্রোবাংলা এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এসব ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। দেশের মোট গ্যাস মজুদ ৩০.১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। যার মধ্যে ১৯.৫ টিসিএফ এরইমধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমান ব্যবহারের হারে আগামী ৯ থেকে ১০ বছর এই মজুদ চলবে।
এসব বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. আমিনুল ইসলাম সম্প্রতি বলেন, নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য আকর্ষণীয় নীতিমালা প্রণয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও আধুনিক অনুসন্ধান কৌশল গ্রহণ, বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্র থেকে সর্বোচ্চ পুনরুদ্ধারের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, নীতিগত সংস্কার ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা এবং বিকল্প জ্বালানির উৎস সন্ধানে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তার মতে, বাংলাদেশ যদি এই চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান করতে পারে, তাহলে দেশীয় গ্যাস উত্তোলন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
Leave a Reply